সুদূর আমেরিকা থেকে বিগত এক মাস ধরে আমি রুদ্ধশ্বাসে বাংলাদেশের শাহবাগের আন্দোলন নিরীক্ষণ করছি। আমার জীবদ্দশায় সম্ভবত বাঙালী জাতির একাংশ কোন একটি বিষয়ে এত তত্পরতা দেখিয়েছে বলে মনে হয়না। এই আন্দোলনের বিষয় অনেক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে অনেক বাংলাদেশী তাঁদের মত জ্ঞাপন করেছেন। আমি শাহবাগের ‘প্রজন্ম চত্বর’ কোনদিন দেখিনি কিন্তু আমারও এই আন্দোলন সম্পর্কে কিছু বলতে ইচ্ছে করে। তবে তার আগে আমার নিজের বিষয়ে কয়েকটি কথা বলা দরকার। আমার পরিচয় পেয়ে অনেকেই আমার বক্তব্য যুক্তিহীন বলে উড়িয়ে দিতে পারবেন জেনেও সেটা দেওয়া আমার কর্তব্য মনে করি।
আমি বাংলাভাষী, বাংলা ভালবাসি, কিন্তু বাংলাদেশী নই। কোনো কালেই আমার কোনো পূর্বপুরুষ (অথবা পূর্বনারী) বাংলাদেশ, পূর্ব পাকিস্তান, বা পূর্ববঙ্গে বসবাস করেননি। সম্পুর্ণ অরাজনৈতিক সংজ্ঞায় ১৯৪৭ সালের আগে সাহিত্যিকরা যে বাংলাদেশের কথা লিখে আমাদের সমবেত ভাষা সমৃদ্ধ করে গেছেন, কেবল সেই অর্থের বাংলাদেশ আমার পূর্বপুরুষরা দেখেছেন। যে দুটি দেশে আমি দীর্ঘদিন কাটিয়েছি- ভারত এবং আমেরিকা – বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রনীতির মধ্যমে বাংলাদেশের প্রতি ঔপনিবেশিক মানসিকতা প্রকাশ করেছে। তবে সেই বিষয় আরেকদিন আলোচনা করা যেতে পারে। ইচ্ছে হলে বাংলাদেশী পাঠক এখানেই পড়া বন্ধ করতে পারেন।
যে দেশের নাগরিক আমি নই এবং যে শাহবাগের আন্দোলনের উপর আমার কোনো অধিকার নেই, সেই বিষয়-এ আমার কেন কিছু বলার স্পর্ধা হল?
এটা ঠিক যে আমি বাংলাদেশী না হলেও বাংলাদেশের অনেক মানুষের সংস্পর্শে এসেছি, তাঁদের শ্রদ্ধা করতে শিখেছি। তাঁদের দেশের ইতিহাস, সঙ্গীত, সাহিত্য এবং সংস্কার সম্পর্কে আমার কিছুটা জ্ঞান লাভ করার সৌভাগ্য হয়েছে। অনেক কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, সঙ্গীত-শিল্পীর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। বলতে বাধা নেই, যে সেটা অনেকখানি সম্ভব হয়েছে আমাদের মাতৃভাষা এক বলে। বাংলা ভাষা ভালবাসি বলেই হয়ত জাহানারা ইমামের জীবনীর অংশ, বা শামসুর রহমানের কবিতা, বা লালন সাঁই-এ গান আমার এতখানি প্রিয়।
কিন্তু আজ যুদ্ধপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার বাংলাদেশ। শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হলেও আমি স্পষ্ট বুঝি যে শাহবাগ মনুষ্যত্বের দাবি। আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি শুধু অতীতের দিকে চেয়ে একটি লঘু দাবি নয়। এটা একটি জাতির সুন্দর আগামীকাল গড়ার দাবি। তাই আজ বলতে আমার মনে এতটুকু দ্বিধা নেই যে লাখো মানুষের স্রোতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের স্বত:স্ফুর্ত দাবির গর্জন আমার হৃদয় ছুঁয়েছে।
আর আমার যেটা মনে হয়েছে সব থেকে বড় কথা, যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবি বাংলাদেশীদের আত্মপরিচয় ফলাও করার দাবি। এখানে ‘বাংলাদেশী’ শব্দ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ভারতীয় বাঙালী আছেন, বিশেষত যাঁদের আদি ঘর “ওপারে,” যাঁরা গভীর স্নেহের সঙ্গে এবং একটা রোমান্টিক আবেগজড়িত সম্ভাবনার চোখে তাঁদের পূর্বপুরুষদের দেশের দিকে চেয়ে থাকেন। আমি সেই আবেগ শ্রদ্ধা করি কিন্তু আমি নিজে সেই আবেগ থেকে বঞ্চিত। আগেই বলেছি যে আমার পারিবারিক কোনও টান নেই বাংলাদেশে। আমি মনে করি বাস্তবরূপে সেই “ওপারের” সমাপ্তি ঘটেছে ১৯৪৭ সালে। ভাষা আন্দোলনের ফলে, গণহত্যার ভয়াবহ অন্ধকারের মধ্যে যুদ্ধে জয়লাভের ফলে, এবং স্বাধীন দেশের একের পর এক সরকারের সম্ভাবনা এবং হতাশাপূর্ণ কার্যকলাপের মাধ্যম-এ গড়ে উঠেছে এক সম্পুর্ণ ভিন্ন পরিচয়ের দেশ এবং মানুষ। যেখানে ১৯৪৭ সালে ছিল বাংলার পূর্বভাগের বাঙালী, সেখানে সৃষ্টি হয়েছে ভিন্ন পরিচয়ের স্বতন্ত্র বাংলাদেশী যাঁর আত্মপরিচয়ের পূর্ণ রূপ পাওয়া যায় ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে। উল্লেখ্য, যে অনেক ভারতীয় বাঙালী বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার সঙ্গে পরিচিত থাকলেও, তাঁদের অনেকেই পরবর্তীকালের বাকশাল-এর ভরাডুবির কথা জানেন না।
আবার ফিরে আশা যাক শাহবাগ এবং বাংলাদেশের কথায়। বলা বাহুল্য, অনেক বাঙালী আছেন যাঁরা বাংলাদেশী নন। আবার বাংলাদেশে, বাঙালী ছাড়াও অন্য জাতির অনেক মানুষ বসবাস করে থাকেন। উপরন্তু, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলিম হলেও, বাংলাদেশের মুসলিম দেশ বলে পরিচয়ের একমাত্র দিক হতে পারেনা। বিশ্বের অনেক দেশ-ই মুসলিম প্রধান – যদি বাংলাদেশীদের পরিচয় শুধুই প্রধান গোষ্ঠীর ধর্মে তবে অনান্য সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য কোথায়? আর তা ছাড়া, শুধু এই পরিচয় তুলে ধরলে সমধর্মী পাকিস্তানীদের বর্বরোচিত আচরণের কথা ভুলে যেতে হয়, এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের অবমাননা করতে হয়।
আমার এত কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই – কোনো ভাবেই ‘বাঙালী’ এবং ‘বাংলাদেশী’ সমার্থক শব্দ মনে করা যেতে পারে না। আবার কোনো ভাভেই বাঙালী মুসলিম আর বাংলাদেশী সমার্থক শব্দ হতে পারে না কারণ অনেক বাঙালী মুসলিম আছেন যাঁরা বাংলাদেশী নন।
এর সঙ্গে শাহবাগের কী সম্পর্ক? অনেক পশ্চিমী প্রচারমাধ্যম শাহবাগের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনটাকে রক্তপিপাসা বা জিঘাংসামূলক প্রচেষ্টা বলে তুলে ধরেছেন। সহস্র মানুষের ভিড়ে কার কী ইচ্ছে তা কারুর পক্ষে নির্দিষ্ট ভাবে বোঝা সম্ভব নয়- কিন্তু যে রূপ ফুটে উঠেছে এক মাসে তা নিশ্চয় আমার মতন অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষের নজরেও পড়েছে! একমাস আমার বাংলাদেশী বন্ধুদের সংযত অথচ দৃঢ় কণ্ঠ শুনে মনে হয়েছে যে শাহবাগ জিঘাংসার দাবি নয়, বরং ন্যায়ের দাবি, এবং বৃহত্তর মানুষের রাষ্ট্রের প্রতি শান্তিপূর্ণ, বিনম্র আবেদন।
প্রচারমাধ্যমের একাংশ শাহবাগের আন্দোলনটাকে ধর্মবিরোধী বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁরা বলেছেন যে ধর্মবিমুখ নাস্তিকরা কেবল অংশগ্রহণ করেছেন। আমি জানি এই গুজব একেবারে মিথ্যে কারণ আমার পরিচিত অনেক ধর্মপরায়ন বাংলাদেশী শাহবাগে গেছেন এই কয়েক সপ্তাহে। আর হলই বা কেউ মুসলিম, বা কাফির, বা নাস্তিক। শাহবাগ সেই প্রশ্ন করেনা, সেই বিষয়ে শাহবাগের মাথা ব্যাথা নেই। ধর্ম ভ্রষ্ট করতে লাখো মানুষ একত্রিত হয়নি।
তাহলে শাহবাগ কী বলে?
শাহবাগ একটি রাষ্ট্রের মানুষের তাঁদের দেশের শত্রুদের বিচারের মধ্যমে দেশের প্রতি বিশ্বাস কায়েম রাখার প্রতীক। শাহবাগ বলে, যাঁরা দেশের উদয়কালে মানুষের আশা পিষিয়ে দেবার জন্য গণহত্যা পর্যন্ত করতে পিছপা হননি এবং পরবর্তীকালে স্বাধীনতাবিরোধী আচরণ করে এসেছেন, তাঁরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন দেশবাসীর সঙ্গে। শাহবাগ বলে প্রত্যেক ‘রাজাকার’ যুদ্ধাপরাধী, কারণ যুদ্ধের সময় এবং পরবর্তীকালে তাঁরা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করেছেন।
আমি যা বুঝেছি, শাহবাগের আন্দোলন বলে- যদি বাংলাদেশ এক অনন্য অবিভাজ্য দেশ, তবে তার প্রধান কারণ যুদ্ধের মধ্যমে দেশের মুক্তিলাভ করা। আর দেশের মধ্যে বসে থেকে এই ইতিহাস অবহেলা করা দেশবাসীর পরিচয় অসম্মান করার সমান।
আমি বাংলাদেশী নই বটে, কিন্তু আরেক স্বাধীন দেশের মুক্ত মানুষ হিসেবে আমি এই বিচারবোধ অবশ্যই শ্রদ্ধা করতে পারি।
শাহবাগ নিয়ে অভ্র এর মূল ডেভলপার এবং ফটোগ্রাফার মেহদী হাসান খানের দুই মিনিটের অসাধারণ টাইম-ল্যাপস ভিডিও তে শাহবাগ আন্দোলনের বিশালত্ব অনুধাবন করা যায়।
সূত্র
দারুণ!
wow.. many thanks for this link..
সময়োচিত এবং সুলিখিত রচনাটির জন্য অভিনন্দন!
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যে এতদিন আটকে ছিল তার কারণ বহির্বিশ্বের কয়েকটি দেশের, আভ্যন্তরীণ কতিপয় রাজনৈতিক দলের এবং মৌলবাদী কিছু মতলবির প্রচণ্ড চাপ। বাংলাদেশ অবশ্যই একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র, কিন্তু বাংলা ভাষায় আমরাও কথা বলি, যেমন বলেন ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের একটি রাজ্যের আর কয়েকটি জেলার লোক। প্রবাসী বাঙালিরা, যাঁরা এখনও বাংলায় কথা বলেন, তাঁরা এ হিসেবের বাইরে।
ধর্মের দ্বিধা বাংলার ইতিহাসে নতুন নয়: বৈষ্ণব বনাম শাক্ত, সনাতন বনাম সদ্ধর্ম, হীনযান বনাম মহাযান, সাবেক হিন্দুত্ব বনাম চৈতন্যের গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ত্ব। তবে এখনকার মত কালিমাময় অর্থপুষ্ট অধার্মিক নোঙরামি আগে কখনো ছিলনা। বাংলা লোকসাহিত্যে সুফি সুর এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভক্তিবাদ ইসলামীয় প্রভাবের সাক্ষী।
কোথায় গেল সেই সব সহনশীলতার জ্বলন্ত উদাহরণ? জাফর খাঁ গাজী ছিলেন এক তুর্কি সেনাপতি; মুক্তবেণী ত্রিবেণীর তীরে এখনও তাঁর সমাধিতে চিরাগ জ্বালান হিন্দুমুসলমান নির্বিশেষে। শেষ বয়সে তিনি হিন্দুধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন। আমিও ছেলেবেলায় ঘোর ব্রাহ্মনদের মুখে তাঁর অপটু সংস্কৃতে লেখা গঙ্গা স্তোত্র (“সুরধুনী মুনিকন্যে …”) শুনেছি — তাঁরা সে স্তোত্রের উত্সানুসন্ধান করার মত বিদ্যাবান ছিলেননা।
আমরা চাইব শাহবাগে বাংলার অরুনোদয় হোক এবং তদনন্তর আমাদের সন্তানেরা যেন দুধেভাতে থাকে – ঠিক ঈশ্বরী পাটনী যা চেয়েছিল। —
শুধু ধন্যবাদ বলে আপনার এই সুন্দর লেখা ছোট করব না। বরং আশা করব যে এই বিষয়ে আপনি আরো কিছু লিখবেন
My father was sent to Bangladesh during the ’71 war with a team of BSNL engineers who looked into setting up and maintaining telecommunication posts set up for the Mukti Bahini and later the Indian Army. He was very happy and excited at the fact that the youth of Bangladesh seem to have finally woken up from their ‘bhaat-ghoom’ and taking infant steps towards justice. Razakars were hated then. They should be hated now. (from the perspective of history, at least). Got him to read your post and he loved it. Said it was exactly what he had wanted to say. Thank you sir! 🙂
wow.. salute to your father.. btw, is BSNL refers to http://www.bsnl.co.in/ ?? are you Bangladeshi??? i want to know more about your father.. is there any way to get some some writings on your father’s great job done in 1971??
অনির্বাণ, অসংখ্য ধন্যবাদ এই জন্য যে, বাংলাদেশী না হবার পর ও আপনি শাহাবাগ নিয়ে দারুন একটা লেখা লিখেছেন…
আপনাকেও ধন্যবাদ জানাই পড়বার জন্য আর শাহবাগ সমর্থন করার জন্য 🙂